কোমল পানীয়

by | Oct 8, 2021 | Blog, Chemistry, Others | 0 comments

কোমল পানীয় হচ্ছে এক প্রকার মাদকবিহীন তরল পানীয়বিশেষ। এতে সচরাচর দ্রবীভূত অবস্থায় কার্বনসমৃদ্ধ পানি । মিষ্টিজাতীয় পদার্থসহ সুগন্ধযুক্ত পদার্থের উপাদান সন্নিবেশিত থাকে।

 কোমল পানীয়কে অনেকে সোডা, পপ, কোক,

 সোডা পপ, ফিজি ড্রিঙ্ক, টনিক বা কার্বনেটেড বেভারেজ নামে ডেকে থাকেন।

যদিও অনেকটা কোমল পানীয় হিসেবে পরিচিত~

পূর্ণ এক গ্লাস বিশুদ্ধ ফলের রস, উচ্চ তাপে প্রস্তুতকৃত হট চকোলেট, চা, কফি, দুধ এবং দুগ্ধজাত পানীয় প্রকৃতপক্ষে এগুলো এধরনের পানীয় হিসেবে বিবেচিত হয় না। তরল পানীয় গ্যাটোরেড এবং পাওয়ারেড কোমল পানীয়ের সংজ্ঞায় পড়ে। তা খেলাধূলায় ব্যবহৃত আদর্শ পানীয়রূপে বিবেচ্য। রেড বুলও এ সংজ্ঞায় পড়ে; কিন্তু তা সাধারণতঃ এনার্জি ড্রিঙ্ক নামে পরিচিত।

হার্ড ড্রিঙ্ক হিসেবে পরিচিত ও নেশাযুক্ত পানীয়ের বিপরীতে কোমল পানীয় সংক্ষেপে সফট্ নামে পরিচিত। এতে স্বল্প পরিমাণে ইথাইল অ্যালকোহলের উপস্থিতি বর্তমানকালে লক্ষ্য করা যায় কিংবা থাকতে পারে। কিন্তু মাদকমুক্ত পানীয়রূপে অ্যালকোহলের মাত্রা অবশ্যই ০.৫% শতাংশের কম হতে হবে।

বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে বিক্রীত এবং জনপ্রিয় সুগন্ধযুক্ত পানীয় হিসেবে – কোকা কোলা। এছাড়াও পেপসি, চেরী, লেমন-লাইম, রুট বিয়ার, অরেঞ্জ, গ্রেপ, ভ্যানিলা, জিঞ্জার এলে, ফ্রুট পাঞ্চ এবং স্পার্কলিং লেমোন্যাড অন্যতম।

ইতিহাস

কোমল পানীয়ের উৎপত্তি ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়ের বিকাশের মধ্যে দিয়ে।  মধ্যযুগীয় মধ্যপ্রাচ্যে শরবতের মতো বিভিন্ন ধরনের ফলের স্বাদযুক্ত কোমল পানীয় ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় ছিল এবং  চিনি ও মধুর মতো উপাদান দিয়ে মিষ্টি করা হতো।  অন্যান্য সাধারণ উপাদানের মধ্যে ছিল লেবু, আপেল, ডালিম, তেঁতুল, কস্তুরী, পুদিনা ইত্যাদি। মধ্যপ্রাচ্যের পানীয়গুলি পরবর্তীকালে মধ্যযুগীয় ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

 কোমল পানীয়(Soft drink) ” শব্দটি ”  আঠারো শতকের শেষের দিকে আবিষ্কৃত সোডা ওয়াটার(Soda Water)” থেকে উদ্ভূত হয়েছে, । জোসেফ প্রিস্টলি 1767 সালে প্রথম কার্বনেটেড ওয়াটার  আবিষ্কার করেছিলেন, যখন তিনি ইংল্যান্ডের লিডসে কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) সহযোগে পানি চালনাকরন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন ।

 টিউডার ইংল্যান্ডে, ‘ওয়াটার ইম্পেরিয়াল’ নামে আরেকধরনের পানীয় ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় ছিল। এটি ছিল লেবুর স্বাদযুক্ত একটি মিষ্টি পানীয় এবং টারটার ক্রিমযূক্ত।

 আরেকটি প্রাথমিক ধরনের এসব পানীয় ছিল লেবুর পানি দিয়ে তৈরি এবং মধু দিয়ে মিষ্টি করা, কিন্তু কার্বনেটেড পানি ছাড়া।  প্যারিসের Compagnie des Limonadiers কে 1676 সালে লেবু পানীয় এবং কোমল পানীয় বিক্রির জন্য একচেটিয়া অধিকার প্রদান করা হয়েছিল।

উৎপাদন প্রণালী

শুষ্ক অথবা তাজা উপাদান হিসেবে লেবু, কমলা ইত্যাদিকে পানির সাথে মিশিয়ে কোমল পানীয় তৈরী করা হয়।

কল-কারখানার পাশাপাশি বাড়ীতেও এধরনের পানীয় তৈরী করা সম্ভব। বাড়ীতে পানির সাথে চিনিমিশ্রিত ঘন দ্রবণ বা সিরাপ, অথবা শুকনো উপাদান হিমায়িত পানি কিংবা বরফমিশ্রিত পানিতে মেশানোর মাধ্যমে কোমল পানীয় তৈরী করা যায়।

 জিঞ্জার এলে এবং রুট বিয়ারজাতীয় পানীয়গুলো হিমায়িত পানিতে মিশিয়ে ফেনার মতো করা হয়। কার্বোনেটেড ওয়াটারে পানিতে উচ্চ চাপে কম ঘনমাত্রার কার্বনডাইঅক্সাইড গ্যাস প্রবেশ করানো হয়।

 H2O (l) + CO2 (g) ⇌ H2CO3 (aq)

 আমরা দৈনন্দিন জীবনে আমরা যেসব এসব পানীয় পান করে থাকি সেগুলোর pH 7 এর চেয়ে অনেক কম থাকে।

যেমন: Coke এবং Pepsi এর pH 2.5 এর কাছাকাছি

আরও ব্লগ পড়ুনঃ

স্বাস্থে প্রভাব

কোমল পানীয়তে ফসফরিক এসিড, ক্যাফেইন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কৃত্রিম চিনিসহ নানা ধরনের রাসায়নিক উপাদানের মিশ্রণ থাকে। খাদ্য হজমে কৃত্রিম পানীয়ের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু কৃত্রিম পানীয় সাময়িক স্বস্তি দিলেও এটি প্রকৃতপক্ষে পাকস্থলীর ভারসাম্য নষ্ট করে। তাছাড়া এই ধরনের পানীয় শরীরের ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমিয়ে দেয় যা পরবর্তীতে হাড়ের ক্ষয়জনিত সমস্যা সৃষ্টি করার পাশাপাশি ক্ষুধামন্দা, অম্লতা বা অ্যাসিডিটি, দাঁতের ক্ষয় বা মেদবৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

অনেক কোমল পানীয়ের মধ্যে আবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে ক্যাফেইন রয়েছে। এ উপাদানটি দুঃশ্চিন্তা এবং অনিদ্রাজনিত রোগে আক্রান্ত হবার প্রধান কারণ বলে স্বীকৃত। পাশাপাশি  কৃত্রিম চিনি শরীরের ক্যান্সার, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

কিন্তু ভরপেট খাওয়ার পরই আপনি যখন আপনার পাকস্থলীতে শূন্য থেকে চার ডিগ্রী তাপমাত্রার কোমল পানীয় ঢেলে দেন । তখন স্বাভাবিকভাবেই হজমের পুরো প্রক্রিয়াটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। হজমের বদলে তখন পাকস্থলীতে থাকা খাবার গাঁজন প্রক্রিয়ায় পঁচতে শুরু করে। কোমল পানীয় পানের কিছুক্ষন পর খাবার হজমের লক্ষন মনে করে আপনি যে তৃপ্তির ঢেকুরটি তোলেন তা আসলে খাবার পচনের ফলে সৃষ্ট গ্যাস।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা কোমল পানীয় সেবনের ব্যাপারে কঠিন সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। তাদের মতে, কোমল পানীয় পানে অভ্যস্ত হলে মূত্রাশয়, মস্তিষ্ক ও পাকস্থলীতে ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনিতে পাথর,ক্ষুধামন্দা, অম্লতা বা অ্যাসিডিটি। এছাড়াও দাঁতের ক্ষয়,হাড়ের ক্ষয়, মেদ বৃদ্ধি, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

ভারতে বিতর্ক  

২০০৩ সালে দিল্লীর একটি  সংস্থা ‘সেন্টার ফর সায়েন্স এন্ড এনভায়রনমেন্ট’ (CSE) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে ভারতে বিক্রিত কোক এবং পেপসি কোমল পানীয়ে ইউরোপীয় অর্থনৈতিক কমিশনের নিরাপদ ও নির্ধারিত মাত্রার চেয়েও ৩০ গুণ বেশি ক্ষতিকর উপাদানের অস্তিত্বের কথা তুলে ধরা হয়।

২০০৩ সালে CSE কোমল পানীয় হিসেবে বিক্রীত ১১টি ব্র্যান্ড নিয়ে একটি গবেষণা করে দেখেছেন। ওইসব পানীয়তে কীটনাশকের পরিমাণ অনেকগুণ বেশি। কোক-পেপসির ৫০ শতাংশ বোতলেই ম্যালাথিয়ন বিষ পেয়েছেন। এবং এই বিষ শহর এলাকায় মশা ও পোকামাকড় মারার জন্য ব্যবহৃত হয়।

যদিও এই বিষয়টা নিয়ে এখনও অনেক মতবিরোধ আছে।

আমাদের সচেতনতা বা করনীয় কি?

এই ক্ষতির পরিমাণ যে অপরিমেয় তা সহজেই অনুমেয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর উচিত নিজেদের নাগরিকদের এই ধরনের পানীয় কম খেতে উদ্বুদ্ধ করা। বিষাক্ত কোমল পানীয় বেচা-কেনা বন্ধে সরকারের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

জাতিকে সুস্থ, সবল ও নেশামুক্ত রাখা সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। জনস্বাস্থ্যের ভাবনা মাথায় রেখে বিশ্বের কয়েকটি দেশে এসব পানীয় উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশেও সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা যায় কিনা তা গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে।

দেশব্যাপী খাদ্যে ভেজাল, ক্রেতা-ভোক্তা অধিকার বিষয়ে যে রাষ্ট্রীয় মনোযোগ তৈরি হয়েছে। সেখান থেকেই এসব কর্পোরেট পানীয় বিষয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং পাশাপাশি আমাদের জনগণের ভেতর প্রচলিত পানীয় রীতিকেই আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও উদ্যোগে আরো জোরদার কায়দায় যুক্ত করতে হবে।

তথ্যসূত্র:

লেখকঃ আব্দুর রাকিব 

0 Comments

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *