টাইম ট্রাভেল নিয়ে যত প্যারাডক্স

by | Jul 4, 2024 | Others | 0 comments

প্যারাডক্স
একজন ব্যক্তি যদি আপনাকে বলে “I am a liar”. তবে কি আপনি তাকে বিশ্বাস করবেন? কারণ লোকটির এ কথা যদি আপনি সত্য ধরে নেন, তবে তার ভাষ্যমতে সে মিথ্যাবাদী। কিন্তু সে যদি মিথ্যাবাদীই হয়, তবে তার ওই কথাটিও মিথ্যা, কিন্তু ওই বিবৃতি যদি মিথ্যা হয়, তাহলে আবার বিবৃতির বিপরীত অর্থানুযায়ী সে সত্যবাদী, আর সে যদি সত্যবাদীই হয়, তাহলে তো তার বলা উক্তিটিও সত্য। এভাবেই স্ববিরোধী দুইটি সমাধান পাওয়া যাচ্ছে। এটা এক ধরনের প্যারাডক্স।
প্যারাডক্স শব্দের আভিধানিক অর্থ হল কূটাভাস। অর্থাৎ এমন কিছু বিবৃতি বা পরিস্থিতি যা থেকে সাধারণত নির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে আসা যায় না। এ সকল উক্তির অর্থ বের করতে গেলে সাধারণত দুটি পরস্পর বিরোধী সমাধান পাওয়া যায় যার কোনটিকে সম্পূর্ণ সত্য বা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলা যায় না। এমন দুটি সমাধানের একটি সত্য হলে অন্যটি মিথ্যা হয় আবার একটি মিথ্যা হলে অন্যটি সত্য হয়। আবার এমন কিছু প্যারাডক্স আছে যার কোন সমাধানই নেই কিংবা জটিল কোন দার্শনিক ব্যাখ্যা আছে। এই ধরনের বিভ্রান্তিকর গাণিতিক বা দার্শনিক বাক্যকেই প্যারাডক্স বলে।
ইতিহাস
প্যারাডক্স শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ ‘প্যারাডক্সন’ থেকে, যা ‘প্যারা’ যার অর্থ ‘বিরোধী’ ও ‘ডক্সা’ যার অর্থ ‘মতামত বা বিশ্বাস’ শব্দদ্বয়ের সম্মিলিত রূপ। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর গ্রিক দার্শনিক ‘জেনো অব এলিয়া’-কে প্যারাডক্সের জনক বলা হয়, যিনি তাঁর দার্শনিক ধাঁধার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর গতি, স্থান ও অসীম সম্পর্কিত প্যারাডক্সগুলো বহু শতাব্দী যাবৎ দার্শনিক ও গণিতবিদদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল, যা তাঁকে প্যারাডক্সের ইতিহাসে কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। যদিও কিছু কিছু ঐতিহাসিক সমসাময়িক গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাস-কে প্যারাডক্সের জনক বলে দাবি করে থাকেন।
ইতিহাসের ১ম প্যারাডক্স সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে প্রাচীনতম প্যারাডক্সগুলো ‘জেনো অব এলিয়া’-র সৃষ্টি বলে ঐতিহাসিকগণ একমত পোষণ করেছেন।


প্যারাডক্সগুলি প্রায়শই আমাদের প্রচলিত চিন্তাভাবনা ও অনুমানকে চ্যালেঞ্জ করে এবং একটি ধারণা বা ঘটনা সম্পর্কে পুনর্বিবেচনা করতে প্ররোচিত করে। গণিত, দর্শন ও বিজ্ঞান নিয়ে অনেক ধরনের প্যারাডক্স প্রচলিত আছে যার সমাধান বা যৌক্তিকতা এখনো বুদ্ধি-অনুশীলনকারীগণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। বিজ্ঞানের অন্যতম চমকপ্রদ বিষয় টাইম ট্রাভেল সম্পর্কিত কয়েকটি প্যারাডক্স নিচে তুলে ধরা হলো :

গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স
টাইম ট্রাভেল সম্পর্কিত সবচেয়ে জনপ্রিয় ও মজার প্যারাডক্স এটি।
মনে করুন শুভ্র একটি টাইম মেশিন বানাতে সক্ষম হলো। সে টাইম মেশিনে করে অতীতে গিয়ে তার বাবা জন্মের আগেই নিজের দাদাকে হত্যা করলো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তার দাদা যদি না থাকে তবে তার বাবার জন্ম হবেনা। আর বাবার জন্ম না হলে শুভ্র’র নিজেরও কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। কিন্তু শুভ্র যদি না থাকে তবে টাইম মেশিনও বানানো হবেনা, দাদাকে হত্যা করাও হবেনা। আবার দাদাকে হত্যা না করা হলে তার বাবা ও সে জন্ম নিবে ও টাইম মেশিনও বানাবে। এটিই হচ্ছে গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স।

বুটস্ট্রেপ প্যারাডক্স
মনে করুন শুভ্র একদিন একটি লাইব্রেরি থেকে শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত বই ‘হ্যামলেট’ এর একটি কপি নিয়ে আসলো। এরপর সে টাইম ট্রাভেল করে অতীতে গিয়ে বইটি শেক্সপিয়ার লিখার আগেই তাঁর কাছে রেখে আসলো। শেক্সপিয়ার ওই বইটি দেখেই ‘হ্যামলেট’ বইটি লিখলো। পরবর্তীতে বইটি খ্যাতি কুড়ালো ও সেই লাইব্রেরিতেও বইয়ের কিছু কপি রাখা হলো যেখান থেকে শুভ্র বইটি নিয়েছিল।
প্রশ্ন হচ্ছে, বইটি আসল লেখক তবে কে?

টুইন প্যারাডক্স
টাইম ট্রাভেলের অন্যতম জটিল প্যারাডক্স টুইন প্যারাডক্স। এটি জানার আগে আমাদের জানতে হবে আইনস্টাইনের ‘স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি’ বা ‘আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব’।
এতে বলা হয়েছে, পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে স্থির প্রসঙ্গ কাঠামোতে কোনো ঘটনার সময়ের ব্যবধান গতিশীল কাঠামোতে ঐ একই ঘটনার সময়ের ব্যবধানের চেয়ে কম হবে। সহজ ভাষায় স্থির কাঠামোতে কোনো পর্যবেক্ষক তার সাপেক্ষে গতিশীল কাঠামোতে সময় দ্রুত চলতে দেখবে। একে ‘টাইম ডায়ালেশন’ বলে।

ধরুন ক ও খ দুই জমজ ভাই। খ কে পৃথিবীতে রেখে ক একদিন মহাকাশযানে করে আলোর কাছাকাছি বেগে মহাকাশ ভ্রমণে গেল ও কয়েক বছর পর ফিরে আসলো। এখন টাইম ডায়ালেশন অনুযায়ী ক এর সাপেক্ষে সে নিজে স্থির ছিল, পৃথিবী তার দিকে গতিশীল ছিল। তাই তার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী তার সময় খ এর তুলনায় ধীরে চলেছে, অর্থাৎ তার বয়স খ এর চেয়ে কম বেড়েছে। সে অনুযায়ী খ এর বয়স, ক এর তুলনায় বেশি হবে। কিন্তু, খ এর সাপেক্ষে ক গতিশীল ছিল ও খ নিজে স্থির ছিল, এক্ষেত্রে তার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী তার সময় ক এর তুলনায় ধীরে চলেছে, অর্থাৎ তার বয়স ক এর চেয়ে কম বেড়েছে। সে অনুযায়ী খ এর বয়স, ক এর তুলনায় কম হবে।
এখানে আসলে কোনটি সঠিক হবে? কার বয়স বেশি হবে?
১৯৮০ সালে বিজ্ঞানী কার্ল সেগান তার বিখ্যাত ‘কসমস’ সিরিজে প্রকাশ করা এ দ্বন্দ্বটিকে প্যারাডক্স বললেও এর কিন্তু যৌক্তিক সমাধান বিদ্যমান। এজন্য ‘স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি’-র ‘লেংথ কনট্রাকশন বা দৈর্ঘ্য সংকোচন’-নিয়ে একটু ভাবলেই সমাধান পেয়ে যাবেন। নিজে নিজে সমাধানটি বের করার চেষ্টা করে দেখুন। বুঝতে পারলেন কি?

লেখক : মোজাম্মেল হক
ক্লাব পজিশন : অর্গানাইজার
ডিপার্টমেন্ট : ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং

0 Comments

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *