‘ডায়াবেটিস’ বর্তমানে ছোট বড় এমন কেউ নেই যে এই শব্দটির সাথে পরিচিত নয়। কিন্তু আসলে কি এই ডায়াবেটিস? ডায়াবেটিস হচ্ছে একটি জটিল রোগ যা রক্তে শর্করা বা Glucose এর মাত্রা বৃদ্ধি করে। রক্তে উচ্চ শর্করার মাত্রা কে Hyperglycemia বলা হয়। কিন্তু রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পায় কেন? শর্করা আমাদের দেহে শক্তি উৎপাদনের জ্বালানি রূপে ক্রিয়া করে। ইনসুলিনের সাহায্যে শর্করা বা Glucose রক্ত প্রবাহ থেকে কোষে প্রবেশ করে। ইনসুলিন হচ্ছে একটি হরমোন যা অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ থেকে উৎপন্ন হয়। রক্তে Glucose এর মাত্রা বৃদ্ধি পেলে ইনসুলিন তৈরির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ইনসুলিন চাবির মতো কাজ করে। প্রতিটি কোষে কিছু রিসেপ্টর থাকে। ইনসুলিন এসব রিসেপ্টরের সাথে বন্ধন তৈরি করে। যার ফলে কোষের Glucose channel খুলে যায় এবং Glucose কোষে প্রবেশ করে। এখন ইনসুলিন উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে ডায়াবেটিসকে তিনভাগে ভাগ করা যায়ঃ
১) টাইপ ১ ডায়াবেটিস: এটি একটি অটোইমিউন অবস্থা যেখানে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী বিটা কোষকে ধ্বংস করে। ফলে খুব কম মাত্রায় ইনসুলিন উৎপন্ন হয় বা উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এটি সাধারণত শিশু-কিশোরদের মাঝে দেখা যায়। এক্ষেত্রে রোগীকে অবশ্যই প্রতিদিন ইনসুলিন গ্রহণ করতে হবে।
২) টাইপ ২ ডায়াবেটিস: এক্ষেত্রে শরীর ইনসুলিনের প্রতি প্রতিরোধী হয়ে উঠে। ফলে শরীর যথাযথভাবে ইনসুলিন উৎপাদন করতে বা কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে না। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের ৯০% টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। প্রাপ্ত বয়স্ক ও অতিরিক্ত স্থূল মানুষের মাঝে টাইপ ২ ডায়াবেটিস বেশি দেখা যায়।
৩) গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস: গর্ভাবস্থার সময় কিছু মহিলার শরীরে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে ইনসুলিনের প্রতি প্রতিরোধ বৃদ্ধি পায়। প্লাসেন্টা দ্বারা নিঃসৃত হরমোন ইনসুলিনের প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। টাইপ ১বা ২ ডায়াবেটিসের মতো লক্ষণ। একে Gestational Diabetes ও বলা হয়।
ডায়াবেটিসের কিছু বিরল প্রকারভেদ হচ্ছেঃ-
১) MODY (Maturity Onset Diabetes of the Young): জিনগত ত্রুটির কারণে হয় যা ইনসুলিনের উৎপাদন বা কার্যকারিতা প্রভাবিত করে।
২) নিওনেটাল ডায়াবেটিস: এটি জিনগত ত্রুটির কারণে শিশুর জন্মের আগেই ইনসুলিন উৎপাদন ও কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে।
৩) প্যানক্রিয়াটিক ডায়াবেটিস: এটি প্যানক্রিয়াসে রোগ বা আঘাতের কারণে হয়।
৪) স্ট্রেস-ইন্ডিউসড ডায়াবেটিস: তীব্র মানসিক চাপ বা শারীরিক অসুস্থতার কারণে হয়।
৫) সেকেন্ডারি ডায়াবেটিস: অন্য কোনো রোগ বা অবস্থার কারণে হয় যেমন সিস্টিক,ফ্রাইব্রোসিস,অগ্ন্যাশয়ে রোগ বা কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
ডায়াবেটিসের ইতিহাস কিন্তু বেশ পুরোনো। প্রায় ৩৫০০ বছরের! ১৫৫২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরে লিখিত প্রাচীন গ্রন্থ ‘এবার্স পেপিরাস’-এ ডায়াবেটিসের মতো একটি রোগের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। এতে অতিরিক্ত প্রস্রাব সমস্যার সমাধানও রয়েছে। চিকিৎসক Hesy-Ra সর্বপ্রথম এই রোগের চিকিৎসায় খাদ্য পরিবর্তনের কথা বিবেচনা করেছিলেন। তিনি যে অবস্থার কথা বলেছিলেন তার আধুনিক বর্ণনা হলো ‘Polyuria’ মানে অতিরিক্ত প্রস্রাব। ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে Susruta,প্রাচীন ভারতীয় শল্য চিকিৎসক ডায়াবেটিস রোগটি চিহ্নিত করেন এবং ‘মধুমেহ’ নামে অভিহিত করেন। প্রাচীন ভারতীয়রা মূত্রে পিঁপড়া আকৃষ্ট হয় নাকি তার উপর ভিত্তি করে ডায়াবেটিস রোগের উপস্থিতি নির্ণয়ের চেষ্টা করতেন। কোরিয়ান,চীনা ও জাপানি ভাষায় ডায়াবেটিসকে বোঝাতে যে শব্দ ব্যবহার করা হয় তা একই আদর্শ চিহ্ন থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ “Sugar urine disease”.
‘ডায়াবেটিস’ শব্দটি ২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরের নিকটবর্তী প্রাচীন শহর আলেকজান্দ্রিয়ার Apollonius প্রথম ব্যবহার করেন বলে ধারণা করা হয়, যার অর্থ ‘drain through’ or ‘siphon’. খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে গ্যালেন মত প্রকাশ করেন যে, ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কিডনিতে ত্রুটি থাকে। তাই তিনি মনে করতেন, এই ত্রুটির ফলে রক্ত থেকে প্রচুর পরিমাণে তরল পদার্থ কিডনির মাধ্যমে প্রস্রাব হিসেবে নিঃসৃত হয়। ১০২৫ সালে ইবনে সিনা নামের এক বহুবিদ্যা বিশারদ তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The canon of medicine’ প্রকাশ করেন। তিনি এই গ্রন্থে ডায়াবেটিস মেলিটাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করছেন। ১৬ শতাব্দীর একজন সুইস চিকিৎসক Philippus Aureolus Paracelus ডায়াবেটিস নিয়ে গবেষণা করেন এবং ‘a serious general disorder’ নামে অভিহিত করেন। তিনিই প্রথম ধারণা দেন,ডায়াবেটিস শুধু কিডনির সমস্যা নয় বরং এটি দেহের বিভিন্ন অঙ্গকে প্রভাবিত করতে পারে এমন একটি জটিল রোগ। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর Thomas Wilis মিষ্টি প্রস্রাবের সাথে রক্তের শর্করার মাত্রার সম্পর্ক সন্দেহ করেছিলেন। ১৬৭৪ সালে তার প্রকাশিত বই ‘Treatise Pharmaceutical Rationalis’-এ ‘ডায়াবেটিস মেলিটাস’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। এখানে মেলিইটাস শব্দটি ‘mellitus’ ল্যাটিন শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘sweetened by honey’. ১৮৬২ সালে ফ্রেডেরিক পেভি হাইপারগ্লাইসিমিয়া এবং গ্লাইকোসুরিয়ার মাঝে পরিমাণগত সম্পর্ক আছে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। আশির দশকে জার্মানিতে মেডিকেল শিক্ষার্থীরা প্যানক্রিয়াসের Islet cells আবিষ্কার করেন। Paul Langerhans এই কোষগুলোকে বর্ণনা করেন তাই “ Islets of Langerhans” নামে কোষ গুলো পরিচিত। কিন্তু তিনি কোষগুলোর কার্যকারিতা ব্যাখ্যা করতে পারেন নি। Oscar Minkowski ১৮৯৩ সালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কুকুরের প্যানক্রিয়াস অপসারণ করে কৃত্রিমভাবে ডায়াবেটিস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। এই পরীক্ষাটি ডায়াবেটিসে প্যানক্রিয়াসের ভূমিকা প্রমাণ করে। ১৯১১ সালে Stanley R. Benedit প্রস্রাবে শর্করা সহজে পরিমাপের একটি নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন যা Benedict’s Reagent Test নামে পরিচিত। ১৯১৬ সালে স্যার Edward Sharpley-Schafer তার প্রকাশিত ‘The Endocrine Organs’ বইটিতে ব্যাখ্যা করেন যে,Islets of Langerhans,এমন একটি পদার্থ নিঃসরণ করে থাকে যা কার্বোহাইড্রেট নিয়ন্ত্রণ করে। ১৯২১ সালে Frederick Banting তার সহকারী Charles Best এর সাহায্যে ইনসুলিন নিঃসরণ করতে সক্ষম হোন। ১৯২২ সালে ডায়াবেটিসের জন্য প্রথম Leonard Thompson কে ‘Isletin’ নামক ইনজেকশন দেয়া হয় এবং পরবর্তীতে তিনি ১৩ বছর বেঁচে ছিলেন। ১৯২২ সালে প্রথম কানাডার টরন্টোতে ইনসুলিন পরীক্ষা করা যায়। ১৯৫১ সালে Frederick Sanger প্রথম ইনসুলিনের সম্পূর্ণ অ্যামিনো অ্যাসিড কাঠামো নির্ধারণ করেন। ১৯৩৯ সালে The American Diabetes Association(A.D.A) গঠিত হয়। ১৯৫৯ সালে ডায়াবেটিসের দুটি প্রকারভেদ আবিষ্কৃত হয়। ১৯৭০ সালে Anton H. Clemens প্রথম Glucose meter Ames Reflectance Meter (ARM) তৈরি করেন। ১৯৮২ সালে Eli Lily & company প্রথম ‘Humulin’ নামে ইনসুলিন বাজারজাত করেন। ১৯৯১ সালে IDF এবং WHO ১৪ নভেম্বরকে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস রূপে পালন করেন ২০০৬ সালে এটি জাতিসংঘ দিবসে পরিণত হয়। IDF এর তথ্য মতে ২০২২ সালে,বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক (২০-৭৯) ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল যা মোট জনসংখ্যার ৮.২%। যা বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা।
লেখক : নাদিরা ইসলাম জিনিয়া
ক্লাব পজিশন : মেম্বার
ডিপার্টমেন্ট : ফার্মেসি
0 Comments